নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশুর আইনি প্রতিকার
দুমুঠো ভাত ও কিছু আয়ের আশায় গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রামে এসেছিল রীনা (১৮)। পরিচিত কয়েকজনের সহায়তায় শহরের একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি পায় সে। কর্মস্থলে পরিচয় হয় মাসুদ নামের এক যুবকের সঙ্গে। পরিচয় গড়ায় প্রেমে। একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের বিনিময়ে। বিয়ের মাসখানেক যেতে না যেতেই রীনার ওপর নেমে আসে যৌতুকের খড়গ। আরো ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের জন্য রীনার শ্বশুর-শাশুড়ি তার পরিবারকে চাপ দেয়। কিন্তু তার পরিবার এই চাহিদা মেটাতে অপারগ। ফলে সরল মেয়েটির ওপর শুরু হয় নির্যাতন। একপর্যায়ে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রীনা।
এ ধরনের অসংখ্য চিত্র আমাদের আশেপাশে দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু এই অভিশাপ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? ২০০০ সালের ৮নং আইন ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’-এর ১১ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য ওই নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন তাহলে ওই স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদন্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন। এখানে মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা বলতে ‘মারাত্মক জখম’ বা ‘সাধারণ জখম’ করাকে বোঝানো হয়েছে।
মারাত্মক জখম বলতে স্থায়ীভাবে দুই চোখের যে কোনোটিতে দৃষ্টিশক্তি রহিতকরণ, স্থায়ীভাবে দুই কানের যে কোনোটির শ্রবণশক্তি রহিতকরণ, যে কোনো অঙ্গের অনিষ্টসাধন, যে কোনো অঙ্গের কর্মশক্তির বিনাশ করা, মস্তক বা মুখম-লের স্থায়ী বিকৃতি, হাড় বা দন্ত ভঙ্গ, যে আঘাত জীবন বিপন্ন করে বা আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ২০ দিন মেয়াদের জন্য তীব্র দৈহিক যন্ত্রণা দেয় বা তাকে তার সাধারণ পেশা অনুসরণ করতে অসমর্থ করে_ এই ধরনের আঘাতকে বোঝায়। মারাত্মক জখমের অপরাধে স্বামী বা স্বামীর পরিবারের সদস্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে অথবা অনধিক ১২ বছর কিন্তু অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন। এছাড়া সাধারণ জখম করার জন্য অনধিক ৩ বছর কিন্তু অন্যূন ১ বছরের সশ্রম কারাদন্ড হবে।
অনেক নারী আছেন যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন এবং ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে এবং অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
যদি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণের ফলে ওই ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে তাহলে অপরাধী ব্যক্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন। অপরাধী যদি ধর্ষণ করার পর ধর্ষিতাকে মেরে ফেলার বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি যেমন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডের পাশাপাশি অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন। যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের কারণে ওই ধর্ষিতার মৃত্যু ঘটে বা ধর্ষিতা আহত হয়, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন। এছাড়া কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ডে এবং অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন। তাছাড়া পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে কোনো নারী যদি ধর্ষিতা হন, তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালে ওইরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে এবং যে ব্যক্তিরা ধর্ষিতা নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে দায়ী ছিলেন তাদের প্রত্যেকে হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৫ বছর অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
এছাড়া সম্ভ্রমহানির কারণে আত্মহত্যার খবর আমরা পেয়ে থাকি। কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কাজের ফলে কোনো নারীর যদি সম্ভ্রমহানি হয় এবং এ কারণে যদি ওই নারী আত্মহত্যা করেন তাহলে ওই ব্যক্তি ওই নারীকে অনুরূপ কাজ দ্বারা আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করার অপরাধে অপরাধী হবেন এবং ওই অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং একই সঙ্গে অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন।
নারী বা শিশু পাচারের অপরাধও বলা হয়েছে এই আইনে। কোনো ব্যক্তি যদি পতিতাবৃত্তি বা বেআইনি বা নীতিগর্হিত কোনো কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশে কোনো নারীকে বিদেশ থেকে নিয়ে আসেন বা বিদেশে পাচার বা প্রেরণ করেন অথবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা কোনো নারীকে ভাড়ায় বা অন্য কোনোভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর করেন বা অনুরূপ কোনো নারীকে তার দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অনধিক ২০ বছর কিন্তু অন্যূন ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ডে এবং অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।
যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীকে কোনো পতিতার নিকট বা পতিতালয়ের রক্ষণাবেক্ষণকারী কিংবা ব্যবস্থাপকের কাছে বিক্রয়, ভাড়া বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করেন, তাহলে তার সাজা মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা অনধিক ২০ বছর কিন্তু অন্যূন ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও অর্থদন্ড। তাছাড়া কোনো পতিতালয়ের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে ক্রয় বা ভাড়া করেন কিংবা অন্য কোনোভাবে কোনো নারীকে নিজের দখলে বা জিম্মায় রাখেন তাহলে তিনিও একই দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৫নং ধারায় এমনটিই বলা আছে।
আইনটির ৬ ধারায় শিশু পাচার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে- যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বেআইনি বা নীতিগর্হিত উদ্দেশে কোনো শিশুকে বিদেশ থেকে আনেন বা বিদেশে পাচার বা প্রেরণ করেন অথবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা উক্তরূপ কোনো উদ্দেশে কোনো শিশুকে নিজ দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং একই সঙ্গে অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন। তাছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নবজাতক শিশুকে হাসপাতাল, মাতৃসদন, নার্সিং হোম, ক্লিনিক ইত্যাদি বা ওই শিশুর অভিভাবকের হেফাজত হতে চুরি করেন তাহলে সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি একই দন্ডে দন্ডিত হবেন।
এছাড়া পাচার করে হোক বা না হোক, যদি কোনো ব্যক্তি ভিক্ষাবৃত্তি বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির উদ্দেশ্যে কোনো শিশুর হাত, পা, চোখ বা অন্য কোনো অঙ্গ বিনষ্ট করেন বা অন্য কোনোভাবে বিকলাঙ্গ বা বিকৃত করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডনীয় হবেন (ধারা ১২)।
নারীর শ্লীলতাহানি বা যৌনপীড়নের খবর আমরা পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখতে পাই। এই আইনের ১০ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশে তার শরীরের যে কোনো অঙ্গ বা কোনো বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌনাঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করেন তাহলে তার এই কাজ হবে ‘যৌনপীড়ন’ এবং এর জন্য ওই ব্যক্তি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ডে এবং অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ তারিখে দৈনিক যায়যায়দিন’এ প্রকাশিত
Posted on ফেব্রুয়ারি 23, 2013, in আইন and tagged নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন. Bookmark the permalink. 16 টি মন্তব্য.
Reblogged this on কালকিনি.নেট.
আপনার সাইটে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
চমৎকার একটা পোস্ট। দারুণ কাজে দিবে। চলতে থাক এমন সব পোস্ট উপহার দেয়া… …
ধন্যবাদ জামি। চেষ্টা করছি আইনি বিষয়গুলো সবার মাঝে উপস্থাপন করতে।
শুভ কামনা।
এই ধরনের পোস্টের মাধ্যমে জন সচেতনতা বৃদ্ধি পাক এটাই কামনা করি। প্রত্যেক ভিকটিম যদি সোচ্চার হয় তাহলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
আইন সম্পর্কে আমাদের আশে পাশের মানুষ সচেতন না হওয়াতে অপরাধীরা অপরাধ করতে সুযোগ পায়। ভিকটিমরা অনেক সময় আইন-আদালতের দ্বারস্থ হতে সংকোচ বোধ করে। এগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।
খুব ভালো পোষ্ট
ধন্যবাদ।
বেশ জানলাম রুমান ভাই।
ধন্যবাদ যাদব দা।
এমন জাদুকরি লেখার মধ্যেই মানুষকে কিছু শেখানো যায়।
ধন্যবাদ আপনাকে।
অপরাধি শাস্তি দেয়য়ার আইনের কোন অভাব নেই তবে প্রশ্ন এই আইন কি সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে? এ দেশে mandatory sentence নামক একটা আইনের নিয়ম আছে, বাংলাদেশে কি সেটা হয় থাকে?
একজন আইনজীবী হিসেবে বলতে পারি- বাংলাদেশে এই আইনটি সঠিক ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে বলে আমার কাছে দৃশ্যমান। তবে কিছু ক্ষেত্রে হয়রানি জন্য কেউ কেউ এই আইনের আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেন। তবে এ ক্ষেত্রেও শাস্তির বিধান আছে।
আর mandatory sentence এর বিধান সব দেশেই থাকে মোটামুটি। সে সুবাধে বাংলাদেশেও আছে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
এমন জাদুকরি লেখার মধ্যেই মানুষকে কিছু শেখানো যায়
ধন্যবাদ আপনাকে।