সিলেট ভ্রমণের ডায়েরি-১

মার্চ ১৩, ২০১১ ইং।

সবে মাত্র ঘুম ভাংলো। সেল ফোনে ঘড়ির সময় দেখি ভোর পাঁচটা। ২ মিনিট পর মোরশেদ ভাই ফোন করলেন (মোরশেদ ভাই সম্পর্কে আমার দুলাভাই হন)।
“সালাম আলাইকুম ভাইয়া, কেমন আছেন?
ওয়ালাইকুম্ সালাম, ভালো আছি; তুমি কেমন আছ? ঘুম ভেঙ্গেছে তোমার?
একটু আগে ভাংলো।
হুম, তাহলে আস্তে ধীরে রেডি হয়ে নাও।
ঠিক আছে ভাইয়া।”
এই বলে ফোন রেখে বিছানা থেকে উঠলাম। আস্তে ধীরে গোসল করে নাস্তা সেড়ে নিলাম। তারপর জামা-কাপড় পড়ে আগের রাতে গুছিয়ে রাখা ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে বাবা-মা’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে অল্প দূরে ভাইয়াদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর তারা (ভাইয়া, সেজ আপু ও ভাগ্নে) টেক্সি নিয়ে হাজির। কুশলাদি বিনিময় করে টেক্সিতে উঠে পড়লাম। তারপর সোজা রেলওয়ে ষ্টেশনে। ষ্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন সকাল ৭টা বেজে ২০মিনিট, ট্রেন ছাড়ার কথা ৮টা ১৫মিনিটে। অর্থাৎ ট্রেন ছাড়তে আরো ৫৫ মিনিট বাকি। ৭টা ৪৫মিনিটে মাইকে ঘোষণা করল যে, সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া “……এক্সপ্রেস” ষ্টেশনে এসে পৌঁছেছে এবং ৮টা ১৫মিনিটে ষ্টেশন ত্যাগ করবে। এরপর আমরা আমাদের নির্দিষ্ট সিট খুঁজে নিলাম।

নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছেড়েদিল। ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে সামনের দিকে ছুটে চলেছে ট্রেন। যাত্রা পথে ট্রেন যখন বিভিন্ন ষ্টেশনে থামল তখন ট্রেনে হরেক রকমের ফেরিওয়ালা দেখলাম। এত রকমের ফেরিওয়ালা আমি এর আগে আমার জীবনে দেখিনি। আনারসের ফেরিওয়ালা, আচারের ফেরিওয়ালা, ডিমের ফেরিওয়ালা, আরো কত রকমের ফেরিওয়ালা! তবে ভিক্ষুকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ট্রেন যখন বিভিন্ন ষ্টেশনে থামে তখন ফেরিওয়ালাদের সাথে ভিক্ষুকরাও উঠে পড়ে ট্রেনে। একটা ষ্টেশনে পৌঁছার পর দুইটা ছোট ছেলে উঠেছিল ট্রেনে। এদের একজন আরেকজনের তুলনায় বয়সে সামান্য বড়। কিছুক্ষন পর এদের একজন গান শুরু করল আর অপর জন গানের তালে তালে হাতে থাকা ছোট্ট বাদ্য যন্ত্র দিয়ে সুর মেলাতে থাকল। ৫/৬ টা গান করে অপর বগিতে চলে গেল ওই দুইজন। যাওয়ার সময় যাত্রীরা যে যা পারল তাদের টাকা দিয়ে তাদের সাহায্য করল।

এগিয়ে চলছে ট্রেন

ঘড়িতে সময় দুপুর প্রায় ২টা। তখন আমি ঘুমে মগ্ন। হঠাৎ মোবাইলে প্রিয়তমার ফোন পেয়ে ঘুম ভাংলো। বেশ কিছুক্ষন কথা বললাম। কথা বলার সময় ট্রেনের ঝিক ঝিকানি শব্দ বিরক্তিকর মনে হল। ফোন রাখার পর পাউরুটি আর কলা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। এর কিছুক্ষন পর ট্রেন অন্য এক ষ্টেশনে থামল। হঠাৎ এক মধ্য বয়সী মহিলা দুইটা চকলেট আর একটা ছোট্ট কাগজ বগিতে থাকা যাত্রীদের সবাইকে ধরিয়ে দিলেন। ছোট্ট কাগজটিতে লেখা ছিল, “আমি পরিবারের সবার বড়, আমার বাবা মারা গিয়েছেন অনেক আগে। পরিবারের সকলের ভরণ-পোষণ আমাকেই করতে হয়। তাই আমি যাত্রীদের কাছে চকলেট বিক্রি করে থাকি। আপনারা এই ২টি চকলেটের বিনিময়ে ৪ টাকা দিয়ে আমাকে ভিক্ষা করার হাত থেকে বাঁচাবেন। ইতি আপনাদের মেয়ে/বোনঃ সাবরিনা।” এই রকম আর্থিক সাহায্য চাওয়ার ধরন এর আগে আমি কখনো দেখিনি। যা হোক ঐ মহিলাটিকে চকলেট ২টার বিনিময়ে ৪টাকা দিয়ে দিলাম।

ট্রেন ছুটে চলছে দূর্বার গতিতে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ট্রেনের গতি অনেক কমে গেছে। আমি মনে করলাম সামনে কোন ষ্টেশনে থামবে হয়ত। কিন্তু জানালার বাইরে যখন তাকালাম তখন নজর কাড়া প্রকৃতির দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না। ট্রেন তখন শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করেছে মাত্র এবং দুই পাহাড়ের আঁকা-বাকা সরু রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। দুইদিকে মনোরম সবুজ চা বাগান চোখে পড়ল। কিছু সুন্দর সুন্দর মসজিদ আর মন্দির চোখে পড়ল। ছোট একটা পাহাড়ের উপর একটা গীর্জাও চোখে পড়েছিল।

দিনের সূর্য আস্তে আস্তে অস্তমিত হতে লাগল। আমরা তখন সিলেটের কাছা-কাছি পৌঁছে গেছি। আর অল্প সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যাব। হ্যাঁ, ঘড়ির কাঁটায় ঠিক যখন সন্ধ্যা ৬টা ২০মিনিট তখন ট্রেন সিলেট ষ্টেশনে থামল। ধীরে সুস্থে ট্রেন থেকে নামলাম আমরা। সিলেট ষ্টেশনে আগে থেকে ভাইয়ার বন্ধু লাকী ভাই ও রাসেল ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তাদের সাথে পরিচিতি হলাম প্রথমে। তারপর তাদের দিক নির্দেশনায় সিলেটের আম্বরখানা মোড়ের পাশে একটা হোটেলে উঠলাম। হোটেলের রুমে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। এরই মধ্যে মা’কে ফোন করে সিলেটে ঠিক মত পৌঁছার খবর জানিয়ে দিলাম।

রাত পৌনে ৯টার দিকে বের হলাম রাতের খাবার সাড়ার জন্য। ভাইয়ার বন্ধুদের সহায়তায় জিন্দাবাজারের পাশে জল্লার পার এলাকার দাড়িয়া পাড়ায় “পাঁচ ভাই রেষ্টুরেন্ট”-এ গেলাম। রেষ্টুরেন্টটিতে যখন ঢুকলাম তখন ভীড় দেখে মনে হল এটা কোন এক কমিউনিটি সেন্টার! প্রথমে দেখে মনে হল কোন সাধারণ মানের রেষ্টুরেন্ট হবে আর কি! পরক্ষনেই বুঝলাম খুবই জনপ্রিয় রেষ্টুরেন্ট সেটি। আমাদেরকে কিছুক্ষন রেষ্টুরেন্টটির বাইরে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এর কারণ সিট খালি ছিল না! খাবারের মান কিন্তু খুবই ভাল। আর খাবারের স্বাদের কথা কখনো ভুলবনা। ঐরকম খাবার আর কোন হোটেল/রেষ্টুরেন্টে খাইনি! যতদিন সিলেটে ছিলাম “পাঁচ ভাই রেষ্টুরেন্টে” দুপুর আর রাতের খাবার খেয়েছিলাম।

রাতের খাবার খেয়ে সোজা হোটেলে ফিরে এলাম। ভ্রমণ জনিত কারণে খুব ক্লান্ত ছিলাম বিধায় তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

(চলবে)

About চাটিকিয়াং রুমান

সবসময় সাধারণ থাকতে ভালোবাসি। পছন্দ করি লেখালেখি করতে, আনন্দ পাই ডাক টিকেট সংগ্রহ করতে আর ফটোগ্রাফিতে, গান গাইতেও ভালবাসি। স্বপ্ন আছে বিশ্ব ভ্রমণ করার...।।

Posted on জানুয়ারি 9, 2012, in ভ্রমণ and tagged . Bookmark the permalink. 8 টি মন্তব্য.

  1. সিলেট শ্রীমঙ্গল পার হওয়ার সময় দু পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যখন ট্রেন যায় তখন চরম লাগে । আর চা বাগান দেখলে তো মন চায় তখনি ট্রেন থেকে নেমে যাই । অ্যাডমিশান টেস্ট দিতে ট্রেন দিয়ে গিয়েছিলাম সিলেট । খুব মজা লাগসে জার্নিটা । তবে শ্রীমঙ্গল এর আগে ট্রেন এক্সিডেন্ট হইসিলো । ওইখানে একটা স্টেশান এ ৫ ঘন্টার মত ছিলাম …। আর সিলেটের ট্রেনটা অত ভালা না :-S

    • ঠিক বলেছ আসলে, সিলেটগামী ট্রেন যখন শ্রীমঙ্গল পার হয় তখন ট্রেন ভ্রমণের অনুভূতি হয় অন্যরকম। এককথায় অসাধারণ! হ্যাঁ, শ্রীমঙ্গলের ঠিক আগে একটা ছোট্ট স্টেশন আছে, তবে এই মূহুর্তে সেই স্টেশনটির নাম মনে করতে পারছিনা।

      মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। :)

  2. ভ্রমণকাহিনী সব সময় বেশ প্রিয়।
    সুন্দর লাগছে পর্বটি। পরের পর্ব পড়ে আসি।

  3. নিজের সিলেট ভ্রমনের কথা মনে পড়ে গেল, আমরাও ট্রেনেই গিয়েছিলাম ঢাকা থেকে। ব্লগে এটা নিয়ে পোস্ট ও আছে আমার। তুমি বোধ হয় কমেন্ট ও করেছিলে। যাইহোক, এখন পরের পড়ব পড়ি :)

  4. এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি যে আপনি ব্লগার “লাবণ্য মেঘমালা” আপু। :D

    হ্যাঁ আপু, আমি আপনার সিলেট ভ্রমণের সেই ব্লগ পোষ্ট পড়েছিলাম। :)

  5. “”হ্যাঁ, শ্রীমঙ্গলের ঠিক আগে একটা ছোট্ট স্টেশন আছে, তবে এই মূহুর্তে সেই স্টেশনটির নাম মনে করতে পারছিনা।”””

    ওই স্টেশনটির নাম “সাতগাঁও” রেল স্টেশন।

    আমাদের সিলেট অঞ্চলে ঘুরে যাবার জন্য রুমান ভাইকে ধন্যবাদ।

চাটিকিয়াং রুমান এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল