ফিরে দেখা ডিসেম্বর: ২য় পর্ব

এই পর্বে থাকছে ৭১’এর ৫ ডিসেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ইতিহাস।

৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১

একাত্তরের এই দিনেও বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন উত্তপ্ত ছিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নয়ের মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আশংকা করেছিলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব শিবির দুইভাগে ভাগ হয়ে সংঘাতে জড়িয়ে যেতে পারে। ৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করার প্রেক্ষাপটে এই দিন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবটি ছিল এই যে, “পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘাতের অবসান ঘটবে।” এই প্রস্তাবে পোল্যান্ড সমর্থন জানায়। কিন্তু চীন ভেটো প্রদান করে এবং অন্যরা ভোটদানে নিজেদের বিরত রাখে। এই দিন জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধি বলেন, কোন শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চউ এন লাই ভারতীয় হামলার মুখে পাকিস্তানকে সর্বাত্নক সহায়তা দেয়ার কথা বলেন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এই উত্তপ্ত অবস্থাতে যাতে মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারিয়ে না ফেলেন সে জন্য মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল ওসমানী জাতির উদ্দেশ্যে বেতারে ভাষণ দেন।

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ডার চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে সকল বিদেশী জাহাজগুলোকে বন্দরে ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বিদেশী জাহাজগুলো এই সময় নিরাপত্তা চাইলে যৌথ কমান্ডার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। পৃথিবীর সব দেশ তখন বুঝতে পারে যে শীঘ্রই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে। এই দিন লেফটন্যান্ট আরেফিনের নেতৃত্বে চালনা নৌবন্দরে এক তীব্র আক্রমণ সংঘটিত হয়। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণের ফলে পাক বাহিনীর সব সৈন্য বন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

৭১ এর এই দিনে আখাউড়া সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। মিত্রবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক অবরোধ করে ফেলে। এর ফলে পাক হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে।

৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় যশোর ও কুড়িগ্রাম। প্রথম কোন জেলা শহর হিসেবে যশোরই প্রথম হানাদার মুক্ত হয়।

মুক্তিযোদ্ধা আর ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তান বাহিনী। ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে তারা খুলনার শিরোমনিতে অবস্থান নেয়। পাক হানাদার বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে যাওয়ার ফলে এই দিন যশোর শত্রু মুক্ত হয়।

এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় কুড়িগ্রাম জেলা। ৮টি থানা নিয়ে সে সময়ে কুড়িগ্রাম একটি মহকুমা ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র আক্রমণ চালিয়ে পরাস্ত করে পাক হানাদার বাহিনীকে। এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় বাহিনীর ৬ষ্ঠ মাউন্টেন ডিভিশনের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে ১৪ই নভেম্বর ভুরুঙ্গামারী, ২৮শে নভেম্বর নাগেশ্বরী ও ৩০ই নভেম্বর উত্তর ধরলা মুক্ত করে। মুক্তিবাহিনী ১লা ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরের চারপাশে অবস্থান নেয়। ৬ তারিখ পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনীর উপর নিয়মিত আক্রমণ চালাতে থাকে। অতঃপর ৬ই ডিসেম্বর বিকেলের দিকে শত্রুমুক্ত হয় কুড়িগ্রাম।

এই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শহীদ লেফটন্যান্ট আশফাকুস সামাদ বীর উত্তম (মরণোত্তর) খেতাব পান। বীর বিক্রম খেতাব অর্জন করেন- শওকত আলী এবং সৈয়দ মনসুর আলী টুংকু। বীর প্রতীক খেতাব পান- বদরুজ্জামান, আব্দুল হাই সরকার, আবদুল আজীজ এবং তারামন বিবি।

৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

১৯৭১ সালের এই দিনে যশোরের কেশবপুর হানাদারমুক্ত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামসরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজয় বরণ করে। কেশবপুরকে শত্রুমুক্ত করে মুক্তিবাহিনী রাইফেলের আগায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উঁচিয়ে কেশবপুর থানায় উত্তোলন করার মধ্য দিয়ে কেশবপুর বিজয় উদযাপন করে। এ সময় কেশবপুর উপজেলার সর্বস্ততের মানুষ বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেন।

রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামসরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিজয় দেখে প্রাণভয়ে কেশবপুর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। আজকের এই দিনটিকে স্বরণীয় করে রাখতে কেশবপুর পৌরসভার উদ্যোগে একটি বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

একের পর এক জায়গা শত্রুমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা বীরবলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আজকের এই দিনে জামালপুর, ময়মনসিংহ, মধুপুরও শত্রু মুক্ত হয়।

৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১

মুক্তিযুদ্ধের আগুন ঝড়া দিনগুলোর আজকের এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় ময়মনসিংহের গৌরীপুর। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৩ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী গৌরীপুরে পৌঁছে। হানাদার বাহিনী ভৈরব রেলপথ দিয়ে গৌরীপুরে পৌঁছে তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের সহায়তায় শুরু করে হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ। পাক বাহিনী নিয়মিত ধ্বংসলীলা চালাতে থাকলে শহরের বাসিন্দারা তাদের ব্যবসা, বসতবাড়ি ফেলে জান বাঁচাতে অন্যত্র চলে যায়।

পাকিস্তান বাহিনীর এই নির্মম অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে, নিজ মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে গৌরীপুরের মুক্তিকামী মানুষ দলে দলে সংগঠিত হতে থাকে। মুক্তিকামী মানুষেরা গৌরীপুর ডিগ্রী কলেজ প্রাঙ্গনে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে হানাদার বাহিনীর উপর একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে। গেরিলা হামলার মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড মেরে ধ্বংস করে গৌরীপুরের রেলপথ, সেতু, গৌরীপুর টেলিফোন একচেঞ্জ। এতে পাক বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা চরম বাধাগ্রস্থ হয়।

১৯৭১ সালের এই দিনেও শত্রুমুক্ত হয় চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার মীরসরাই। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাক হানাদার বাহিনী মীরসরাই ছেড়ে পালিয়ে যায়। মীরসরাইয়ের বিজয় উল্লাসে সে দিন মাতোয়ারা হয়েছিল সর্বস্তরের মানুষ। মুক্তিযোদ্ধারা মীরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ময়দানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মীরসরাইয়ের বিজয় উদযাপন করেন সে দিন।

মীরসরাই উপজেলার তালবাড়িয়া রেলষ্টেশন রোডের লোহার ব্রীজ নামক স্থানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী তাদের এদেশী দোসর রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামস বাহিনীর সহায়তায় অগনিত মুক্তিযোদ্ধা, নারী, শিশু, পুরুষদের ধরে নির্মমভাবে জবাই করে হত্যা করে লোহার ব্রীজের নিচে ফেলে দিত।

About চাটিকিয়াং রুমান

সবসময় সাধারণ থাকতে ভালোবাসি। পছন্দ করি লেখালেখি করতে, আনন্দ পাই ডাক টিকেট সংগ্রহ করতে আর ফটোগ্রাফিতে, গান গাইতেও ভালবাসি। স্বপ্ন আছে বিশ্ব ভ্রমণ করার...।।

Posted on ডিসেম্বর 5, 2012, in মুক্তিযুদ্ধ. Bookmark the permalink. 8 টি মন্তব্য.

  1. but that paki had not punnished

  2. তথ্যবহুল পোস্ট। নিয়মিত আপডেট করুন রুমান ভাই। জিনিসটা আপনার যেমন কাজে দেবে, আমাদেরও সংগ্রহশালা সমৃদ্ধিতে সহায়তা করবে :)

  3. ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় যশোর, আর ঐ দিনই ভারত প্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়! ব্যাপারটা মনে হতেই গা শিউরে ওঠে।

  4. ভারত আর ভুটানের স্বীকৃতির ব্যাপারটা আনলে মনে হয় আরেকটু সমৃদ্ধ হতো, তাই না? ভালো লাগছে।

মন্তব্য করুন