সিলেট ভ্রমণের ডায়েরি- শেষ পর্ব

মার্চ ১৫, ২০১১ ইং।

সকাল পৌনে ৮টায় রেষ্টুরেন্ট থেকে প্রাতঃরাশ সেড়ে রাস্তার পাশে দাড়ালাম। এদিকে লাকী ভাই জাফলং যাওয়া-আসার উদ্দেশ্যে আমাদের জন্য সিএনজি ভাড়া করছে। ১০মিনিট পর তিনি আমাদের জানালেন ১০০০ টাকার কমে সিএনজি যেতে রাজি হচ্ছেনা। ভাইয়া উনাকে আরো ২/১টা সিএনজি দেখতে বললেন এর চেয়ে কম দামে যায় কিনা দেখার জন্য। এর কিছুক্ষণ তিনি বললেন, সিএনজি ঠিক করা হয়েছে, ভাড়া ৯০০টাকা। তারপর আমরা উঠে পরলাম নির্ধারিত সিএনজি’তে। ঠিক ৮টায় রওনা দিলাম জাফলং সহ আরো কয়েকটি পর্যটন স্থানের উদ্দেশ্যে।

সিএনজি ছুটে চলছে সামনের দিকে। আর আমরা অবলোকন করছি আশ-পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য। হঠাৎ টেক্সি ডানে মোড় নিল। মেইন সড়ক থেকে প্রায় ২০গজ ভিতরে ঢুকে টেক্সি থামিয়ে চালক বললেন, এটা হল- জৈন্তাপুরের জৈন্তা রাজপ্রাসাদ। ততক্ষণে আমরা সিলেট শহর থেকে ৪৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। এই জৈন্তাপুর প্রাচীন রাজার রাজধানী নামে খ্যাত। ১৮ শতকে জৈন্তা রাজার রাজধানী ছিল এই জৈন্তাপুর। এটি জৈন্তাপুর বাজারের কাছে। ঘুরে ফিরে দেখলাম জৈন্তা রাজপ্রাসাদ। বর্তমানে ধ্বংশ প্রায় এই রাজপ্রাসাদটি দেখতে অনেক পর্যটক আসে। রাজপ্রাসাদ এলাকার মাঝে একটা কূপ দেখলাম। পরে টেক্সি চালকের মাধ্যমে জানতে পারলাম এটা আসলে কূপ নয়। সে সময়ে মৃত্যুদন্ড হিসেবে রাজার আদেশে শিরচ্ছেদ করে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির মাথা এই কূপের মধ্যে ফেলে দেয়া হত।

এই সেই কুখ্যাত কূপ

রাজপ্রাসাদটি দেখে আমরা রওনা দিলাম জাফলং-এর উদ্দেশ্যে। জৈন্তাপুর থেকে জাফলং যাওয়ার পথে দূরে উঁচু উঁচু পাহাড় চোখে পড়ল। ঘড়িতে সময় যখন প্রায় ১০টার কাছাকাছি তখন আমরা পৌঁছে গেলাম জাফলং-এ। সেখানে পৌঁছে একটা মোটামুটি মানের খাবারের হোটেল থেকে নাস্তা সেড়ে বেরিয়ে পড়লাম জাফলং-এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য। একটা কথা উল্লেখ্য যে জাফলং পিয়াং নদীর তীরে অবস্থিত। সারিবদ্ধ বেশ কয়েকটা দোকান দেখতে পেলাম পিয়াং নদীর তীরে যেখানে রয়েছে- মনিপুরী, ত্রিপুরী, খাসিয়া সহ আরো বেশকয়েকটি নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী কর্তৃক তৈরী করা কাপড়ের দোকান, পাথর খোদাইয়ের দোকান, আরো রয়েছে পাঠা তৈরীর দোকান সহ কসমেটিক্সের দোকান। নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীদের তৈরী করা কাপড়ের চাহিদা রয়েছে বেশ। একেকটি শাড়ির দাম ৫০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা। শাড়ি ছাড়া রয়েছে- বেডসিট, শাল, মেয়েদের ওড়না, সালোয়ার কামিজ।

পিয়াং নদী থেকে পাথর তোলা শিল্প দেখলাম হেঁটে হেঁটে। জাফলং-এর অন্যতম আকর্ষণ “জাফলং জিরো পয়েন্ট”। সেখানে যাওয়া-আসার জন্য ৪০০টাকা দিয়ে একটা ইঞ্জিন চালিত বোট ভাড়া করলাম। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জিরো পয়েন্টে। যেখানে একপ্রান্তে বিজিবি’র চৌকি অন্যপ্রান্তে বিএসএফ’এর চৌকি। একপাশে ভারতের খাসিয়ারা পিয়াং নদীতে গোসল সাড়ছে এবং মাছ শিকার করছে আর অন্যপাশে একই নদীতে বাংলাদেশী পর্যটকরা আনন্দ সহকারে গোসল করছে। শুধু মাঝখানে একটা সীমান্ত রেখা। নদীর পানি কিন্তু খুবই ঠান্ডা এবং স্বচ্ছ। এদিকে বিজিবি ও বিএসএফের সদস্যরা বাংলাদেশী পর্যটক ও ভারতীয় খাসিয়াদের প্রতি দৃষ্টি রাখছে যাতে তারা ভুলকরে সীমান্ত অতিক্রম না করে।

পিনাং নদী থেকে পাথরের গুড়ি তুলছে শ্রমিকরা

জাফলং জিরো পয়েন্টে

ঘন্টা খানেকের মত জিরো পয়েন্টে থাকার পর আবারো বোটে করে রওনা দিলাম জাফলং-এর প্রধান কেন্দ্রে। ২০ মিনিটের মধ্যেই চলে আসলাম জাফলং-এর প্রধাণ কেন্দ্রে। জিরো পয়েন্টে যাওয়া-আসার পথে পিয়াং নদী থেকে শ্রমিকদের কর্তৃক পাথর তোলার দৃশ্য সত্যিই চমৎকার। বোট থেকে নেমে শখের বশে নদীর তীর থেকে কয়েকটা পাথরও সঙ্গে নিলাম। এরপর উপরোল্লিখিত দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করলাম। আরো কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করার পর জাফলংকে বিদায় জানিয়ে টেক্সি করে আমরা রওনা দিলাম সিলেটের উদ্দেশ্যে।

জাফলং থেকে সিলেটে ফেরার পথেই পড়বে তামাবিল স্থলবন্দর। জাফলং থেকে তামাবিল স্থলবন্দরের দূরত্ব মাত্র আড়াই কিলোমিটার। ভারত থেকে বাংলাদেশে কয়লা আসে এই স্থলবন্দর দিয়ে। তামাবিলের ওপারে হচ্ছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। তামাবিল সীমান্তের পাশেই রয়েছে ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সমাধিস্থান।

তামাবিল সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থান

তামাবিল জিরো পয়েন্ট

তামাবিল থেকে রওনা হলাম-শ্রীপুরের উদ্দেশ্যে। শ্রীপুর হচ্ছে একটা পর্যটন স্থান। জাফলং এবং তামাবিল ভ্রমণের পর সিলেটে ফেরার পথে শ্রীপুর ভ্রমণ করতে পারেন। জাফলং থেকে এর দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। সুন্দর সুন্দর গাছ এবং একটি লেক রয়েছে সেখানে। কিন্তু ঐ লেকটি পানি শুন্য! সুন্দর সময় কাঁটানোর একটা আদর্শ স্থান হতে পারে শ্রীপুর পর্যটন স্থানটি।

এসব কিছু দেখে রওনা হলাম সিলেটের উদ্দেশ্যে। সিলেট শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল প্রায় পৌনে ৪টা। এরপর “পাঁচ ভাই রেষ্টুরেন্ট” থেকে দুপুরের খাবার সেড়ে ফিরলাম হোটেলে।

এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে সবাইকে নিয়ে বের হলাম সিলেট শহরে ঘুরার জন্য। সিলেট শহরে ঘুরতে ফিরতে কয়েকটা উপহার সামগ্রী কিনলাম। রাত সোয়া ৮টার দিকে হোটেলে ফিরে আসলাম। হোটেলে ফিরে সবার সাথে আড্ডা দিয়ে অলস সময় কাটাতে লাগলাম। এর ঘন্টাখানেক পর খাবারের হোটেল থেকে আনা রাতের খাবার হোটেল রুমেই সেড়ে পরের দিন সকালে চট্টগ্রাম ফেরার প্রস্তুতি স্বরূপ সবকিছু গুছিয়ে নিলাম।

পরেরদিন অর্থাৎ ১৬ তারিখে সকালে ঘুম থেকে উঠে সবকিছু সেড়ে সিলেট রেলওয়ে ষ্টেশনের দিকে রওনা হলাম। ষ্টেশনে পৌঁছে লাকী ভাই আর রাসেল ভাইদের সাথে গল্প করে ট্রেন ছাড়ার আগের সময়গুলো কাটিয়ে দিলাম। যখন ট্রেন ছাড়ার সময় হল তখন তাদের (লাকী ভাই আর রাসেল ভাই) কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। ঘড়িতে সময় যখন ১০:২০ মিনিট তখন ট্রেন সিলেট ষ্টেশন ছেড়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। রাত যখন পৌনে ৯টা ট্রেন তখন চট্টগ্রাম ষ্টেশনে এসে পৌঁছল। অতঃপর আমার সিলেট ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটল।

About চাটিকিয়াং রুমান

সবসময় সাধারণ থাকতে ভালোবাসি। পছন্দ করি লেখালেখি করতে, আনন্দ পাই ডাক টিকেট সংগ্রহ করতে আর ফটোগ্রাফিতে, গান গাইতেও ভালবাসি। স্বপ্ন আছে বিশ্ব ভ্রমণ করার...।।

Posted on জানুয়ারি 27, 2012, in ভ্রমণ and tagged , . Bookmark the permalink. 9 টি মন্তব্য.

  1. সবথেকে ভাল লাগলো এই শেষ পর্বটি। ছবিগুলোও অনেক ভাল লাগলো।

  2. বাহ, তোমার আমার ভ্রমন স্পট গুলো আলাদা হওয়াতে আরও ভালো লাগলো, এরপর যদি কোনদিন সিলেট যাওয়ার সুযোগ হয়, জাফ্লং ঘুরে আসব। ভালো লাগলো তোমার সিলেট ভ্রমনের ডায়েরি!

  3. ছবিগুলো অসাধারন তুলেছেন!
    সিলেট ভ্রমন করে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন