ফিরে দেখা ডিসেম্বর: ১ম পর্ব

আজ ১লা ডিসেম্বর। বিজয়ের মাস, গৌরবের মাস ডিসেম্বরের শুরু। ১৯৭১ সালের এই মাসেই দীর্ঘ ৯ মাস পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর সূচিত হয় মহান বিজয়ের গৌরবময় অধ্যায়, আসে আমাদের কাঙ্খিত বিজয়।

পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী থেকে মুক্ত হওয়া এই মহান বিজয়ের মাস একই সাথে স্বজন হারানো শোকার্ত মাস। বাংলার শহীদ বীর সন্তানদের স্মরণে এই মাস নানান কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে পালিত হবে। ৭১’এর ১লা ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করে সবার মাঝে তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

৭১-এ এই সময়টাতে মুক্তিযুদ্ধ সর্বাত্মক রূপ পায়। মুক্তিবাহিনীর কাছে দিন দিন কোনঠাসা হয়ে পড়ে পাক বাহিনী। একের পর এক প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। ১৯৭১ সালের এই দিনে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, গেরিলা সন্দেহে জিঞ্জিরার অনেক যুবককে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ের এই গ্রামটিতে অন্তত ৮৭ জনকে হত্যা করেছে পাক হানাদার বাহিনী। নারী, শিশুরা পর্যন্ত তাদের নিষ্ঠুরতার হাত থেকে রক্ষা পায়নি।

এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদে বক্তৃতাকালে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইয়াহিয়া খানের প্রতি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্থানি সৈন্য প্রত্যাহারের আহবান জানান। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাক বাহিনী সিলেটের শমশেরনগর থেকে পালাতে থাকে। এ সময়ে মুক্তিবাহিনী টেংরাটিলা ও দুয়ারাবাজার শত্রু মুক্ত করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণের ফলে পাক বাহিনী সিলেটের গারা, আলিরগাঁও, পিরিজপুর থেকে তাদের বাহিনী গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

জুলফিকার আলী ভুট্টো দুমাস আগে ঢাকায় পিপলস পার্টির যে অফিস উদ্ভোধন করে সেখানে বোমা বিস্ফোরনের ফলে তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এদিনে।

২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

একাত্তরের এই সময়ে বাংলার দামাল সন্তানেরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতিদিন কোনঠাসা হতে থাকে পাক বাহিনী। নভেম্বরের শুরু থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে। সীমান্ত এলাকাগুলোতে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। আর এদিকে দেশ জুড়ে চলছিল প্রতিরোধ। প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হচ্ছিল পাক বাহিনী।

মুক্তিযোদ্ধারা দিনাজপুরে আকস্মাৎ এমন এক হামলা চালায় যার জন্য প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তান বাহিনী। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী পঞ্চগড় মুক্ত করে এগিয়ে চলছিল ঠাকুরগাঁওয়ের দিকে। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় রামপুরা ও মালিবাগে এদিন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। আন্তর্জাতিক মিডিয়া সমূহে তখন মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ হয়।

৭১ সালের এ দিনে মুক্তিযোদ্ধারা যখন রাজধানী ঢাকাকে দখলমুক্ত করার লক্ষ্যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাকার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছিল নানা অপপ্রচার। এ দিকে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে প্রতিদিন শহীদ হচ্ছিল হাজারো মুক্তিকামী জনতা। হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছিল না মা বোনেরা।

নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামের পথে পথে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। আখাউড়া রেল স্টেশনে চলে সম্মুখযুদ্ধ। একাত্তরের এই দিনে ময়মনসিংহ, জামালপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী।

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

৭১ এর ডিসেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর একেরপর এক হামলায় পাক হানাদারেরা তখন দিশেহারা। এই মাসের শুরু দিক থেকে বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের বেশে সামনে দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুক্তিবাহিনীর সাথে পেরে উঠতে না পেরে পাকিস্তান বাহিনী হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন বাড়িয়ে দিল আগের চাইতে বেশি পরিমাণে।

১৯৭১ সালের এই দিনে ভারতে বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারতের মধ্যেকার যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিয়ে জাতিসংঘের কাছ সুবিধা আদায় করা। তারা চেয়েছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা আদায়। পাকিস্তান চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকে যদি দুই দেশের মধ্যেকার যুদ্ধ হিসেবে দেখানো যায় তাহলে জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার জন্য উভয় পক্ষকে বাধ্য করবে এবং উভয় দেশে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করবে। আর এতে করে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থান করবে। এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনী এই দিন বিকেলের দিকে ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোর্ট, শ্রীনগর, অবনত্মীপুর, উত্তরালই সহ দিল্লির কাছাকাছি আগ্রার বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। ভারতের উপর পাকিস্তান বাহিনীর এই হামলা পরিপ্রেক্ষিতে রাত সাড়ে ১১টায় ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের উপর পাল্টা হামলা চালায় এই দিনে।

এদিনে তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন জানায়, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে যেকোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তারা ভেটো দিবে।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে বরগুনা শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বরগুনার বিভিন্ন জায়গায় পাক হানাদার বাহিনী পৈশাচিক নারী নির্যাতন ও নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।

৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১

১৯৭১ সালের এই সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য সময়টুকু ছিল অস্থির আর উদ্বেগের। এই দিনে জাতিসংঘে চলে চরম উত্তেজনা। কারণ পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারতের মধ্যেকার যুদ্ধ হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করা। যার ফলে পাকিস্তান বাহিনী অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করার সুযোগ পাবে। যুক্তরাষ্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দাবি করে যে, “এই মূহুর্তে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।” উল্লেখ্য, জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারতের মধ্যেকার যুদ্ধ হিসেবে জাতিসংঘে উপস্থাপন করার জন্য পাকিস্তান বিমানবাহিনী ৭১ এর ৩ ডিসেম্বর ভারতের বেশ কয়েকটি জায়গায় বিমানহামলা চালায় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে একই তারিখে রাতের বেলা ভারত পাকিস্তানের উপর হামলা চালায়।

এই যখন উৎকন্ঠাময় অবস্থা তখন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লিখিত এক পত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহবান জানান।

যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাশ করানো জন্য যুক্তরাষ্ট্র তখন বৈঠকের পর বৈঠক করছে। সবাই যখন চরম উদ্বেগ আর চিন্তার মধ্যে ছিলেন তখন আসলো খুশির সংবাদ। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রধানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে ভেস্তে যায়। পোল্যান্ডও এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে আরো একটি আনন্দের সংবাদ ছিল যে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা।

এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট যখন হেরে গিয়েছিল তখন পক্ষন্তরে পাকিস্তানের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ তীব্র আক্রমণের মুখে বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গা থেকে পালানোর পথ খুঁজতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি জামাতে ইসলামীর আমীর আবুল আলা মওদুদী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জানান যে, “প্রতিটি দেশপ্রেমিক মুসলমান প্রেসিডেন্টের সাথে রয়েছে।”

মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে লক্ষীপুর হানাদার মুক্ত হয়। যুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আশ-শামস বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষনের ঘটনায় লক্ষীপুর ছিল বিপর্যস্ত।

একাত্তরের এই দিনে ৩নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শমশেরনগর বিমান বন্দর এবং আখাউড়া রেল স্টেশন দখল করেন। ৮নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেন মেহেরপুর। এছাড়া ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে কামালপুর নিজেদের আয়ত্তে আনেন।

About চাটিকিয়াং রুমান

সবসময় সাধারণ থাকতে ভালোবাসি। পছন্দ করি লেখালেখি করতে, আনন্দ পাই ডাক টিকেট সংগ্রহ করতে আর ফটোগ্রাফিতে, গান গাইতেও ভালবাসি। স্বপ্ন আছে বিশ্ব ভ্রমণ করার...।।

Posted on ডিসেম্বর 1, 2012, in মুক্তিযুদ্ধ. Bookmark the permalink. 22 টি মন্তব্য.

  1. মুক্তিযোদ্বারা দেশের শ্রেষ্ট্ সন্তান।

  2. রুম্মান ভাইয়া অনেক দিন পর ব্লগে আসে লেখাটা দারুন লাগল। একটা প্রশ্ন ছিল।আপনার ব্লগে প্রথম পাতায় দেখি কোন লেখস সম্পূর্ণ না এসে একটা সামারি আসে। এটা কিভাবে করেছেন? প্লিজ বলবেন?

  3. রুমান ভাই আমি আপনার মত সাইটি সাজাতে চাই ।
    দয়া করে আমাকে সাহায্য করবেন কি ?
    মেইল- dr.abdulhairahat@gmail/live.com

  4. অনেক ভালো লাগা পোস্ট ।
    ইতিহাস সমৃদ্ধ ।
    শুভকামনা ।

  5. আমাদের বিজয় নিয়ে আপনার একান্ত উদ্যোগ সত্যি অতুলনীয়। চলুক… শুভকামনা আপনার জন্য।

  6. বিজয়ের মাসে বিজয়ের গান। অনেক ভালো পোস্ট

  7. আপনার ডিসেম্বরের লেখাগুলো যে কখন পাব? কাল আবার ঢাকায় যাচ্ছি। পরের লেখাগুলো পড়ব এসে…দোয়া করবেন।

  8. ১৬ ডিসেম্বরের রাতে তোমার লেখাগুলো পড়তে বসেছি। লেখাগুলো আগে দেখেছি, কিন্তু সময়াভাবে পড়া হয় নি।
    কালেকশনে রাখতে হবে।

  9. রুমান
    ভাই আপনার ফোন নম্বরটা দিবেন । আমি এনটিভি অন লাইন থেকে বলছি ।

  10. রুমান ভাই আপনার নাম্বার টা দরকার।

মন্তব্য করুন